গত ৩০ বছর ধরে সঙ্গীতদুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন লোপামুদ্রা মিত্র। তাঁর কণ্ঠ এমনই যে, দ্বিতীয় কোনও শিল্পী কোনও দিন তাঁর জায়গা নিতে পারেননি। তাঁর গানের মতোই তাঁকে অনায়াসে বলা যায়, ‘তোর মতন কেউ নেই…’। এই দীর্ঘ সফরে কতটা প্রাপ্তি, কতটা আক্ষেপ? ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘আনন্দাবাজার অনলাইন’-এর সঙ্গে স্মৃতিচারণ করলেন সঙ্গীতশিল্পী।
প্রশ্ন: ৩০ বছরের মধ্যে কোন দিনটার কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে?
লোপামুদ্রা: প্রথম যে দিন এইচএমভি স্টুডিয়োয় গিয়েছিলাম, সেই দিনটার কথা সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ে। সেখানে গান রেকর্ড করা, সেই স্বপ্নের গ্রামোফোন, কত কী! কিন্তু ভাবলে খারাপ লাগে, সেই এইচএমভি-র নস্ট্যালজিয়াও এখন আর নেই। গত ৩০ বছরে কত কিছু বদলে গিয়েছে এই গানের দুনিয়ায়। মাঝেমাঝে আক্ষেপ হয়, যে অনেক কিছু করা হল না। যেমন আমার খুব ইচ্ছা ছিল ‘বেণীমাধব’ গানটা একটু অন্য ভাবে আরও এক বার রেকর্ড করি। কিন্তু কোথায় যাব, কাকে বলব, কিছুই তো বুঝতে পারি না এখন আর। তাই খারাপ লাগে।
প্রশ্ন: এত বছর পর সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগার জায়গা কোনটা?
লোপামুদ্রা: সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে যে, এই দিনটা আমার গুরু সমীর চট্টোপাধ্যায় (কাকা) দেখে যেতে পারলেন না। আমি যে এত দূর আসতে পেরেছি, বা যে জায়গায় পৌঁছেছি, সেটা কাকা না থাকলে হত না। আমার বাবাও বোধ হয় কোনও দিন ভাবতে পারেননি, আমি এ ভাবে গান করব। ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। প্রায় ২ ঘণ্টার অনুষ্ঠানে কোন কোন গান গাইব, সেই তালিকাটাও মনে হচ্ছে, কাকা থাকলে বেশি ভাল তৈরি করে দিতে পারতেন। কিন্তু এখন কারও সঙ্গে সে ভাবে আলোচনা করতে পারছি না, এই যা খারাপ লাগা। তা ছাড়া আমার বেশ উৎফুল্লও লাগছে। এই রকম একটি অনুষ্ঠান যে কোনও দিন আমার জন্য হবে, তা ভাবিনি।
প্রশ্ন: লোপামুদ্রা মানেই যেন প্রতিবাদী গান! এই ভাবমূর্তি কি সচেতন ভাবে গড়ে তোলা?
লোপামুদ্রা: একদমই নয়! আমায় কেউ এই তকমা দিলে বড় লজ্জা করে। কারণ আমি মনে করি না, কোনও দিনই কোনও কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে উঠতে পেরেছি। আমি আদ্যপান্ত ভীত এক জন মানুষ। অনেক কিছু দেখলেও চোখ বন্ধ করে থাকি। অশান্তির ভয়ে কিছুই বলি না। হয়তো সেই কারণেই মনের ভিতর এক ধরনের জ্বালা তৈরি হয়। এবং সেগুলোই আমার গানের ভাষায় ফুটে ওঠে।
প্রশ্ন: আপনার আশপাশের অনেক সঙ্গীতশিল্পী রাজনীতি জগতের সঙ্গে সরাসরি ভাবে যুক্ত। ভীতু বলেই কি সেই পথে আপনি নিজে কোনও দিন হাঁটলেন না?
লোপামুদ্রা: না, সেটা কিন্তু একদমই না। আমি মন থেকে বিশ্বাস করি, শিল্পীর কোনও রং থাকা উচিত নয়। আগে যে কোনও রাজা তাদের রাজত্বকালে সেই রাজ্যের সংস্কৃতি জগতের উন্নতি করার চেষ্টা করত। আমি বামফ্রন্ট-তৃণমূল দুই আমলেই কাজ করেছি। কিন্তু মনে যাই থাকুক, কোনও পক্ষ নিয়ে বিষয়ভিত্তিক প্রতিবাদ করায় আমি বিশ্বাস করি না। আবার সরকারি কোনও অনুষ্ঠানে আমি গান গাইছি মানেই যে, আমায় কোনও এক দিকের শিল্পী বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে, সেটাও অনুচিত।
প্রশ্ন: আপনি প্রতিবাদ না করলেও নেটমাধ্যমে মাঝেমাঝে ট্রোলদের যোগ্য জবাব দিতে ছাড়েন না…।
লোপামুদ্রা: আসলে যাদের অধিকার নেই, তারাও সারা ক্ষণ কচকচ করে এমন সব কথা বলে যে, নিজেকে ধরে রাখা যায় না। নেটমাধ্যমের জন্য এ সব এখন খুব সহজ হয়ে গিয়েছে। সকলে ভাবেন, যা ইচ্ছা বলা যায়। এদের কড়া জবাব না দিলে আরও মাথায় চেপে বসে। জয় (সরকার) অবশ্য আমায় বোঝায় যে, এত কথা বলার প্রয়োজন নেই।
প্রশ্ন: জয় সরকার কি আপনার সৃষ্টিশীল জীবনের সবচেয়ে বড় সঙ্গী?
লোপামুদ্রা: সবচেয়ে বড় সঙ্গী অবশ্যই আমার কাকা। যে ভাবে গান করি, তার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান আমার কাকারই। কাকা না থাকলেও হয়তো আমি গান গাইতাম, কিন্তু অন্য ভাবে। জয় আমার খুব ভাল বন্ধু। বাড়িতে এমন এক জন সঙ্গীতশিল্পী থাকলে যে ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, বা যে ধরনের কাজ একসঙ্গে হতে পারে, সেগুলো অবশ্যই হয়েছে। তবে জয় যা করার, তা ঘরে একটা গিটার থাকলেও করে ফেলবে। ওর কাছে বউ আর গিটারের কোনও তফাত নেই (হাসি…)। কিন্তু কাকা ছিলেন আমার সত্যিকারের মিউজিক্যাল গাইড।
প্রশ্ন: ৩০ বছরে কি আপনাকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা একটু কম হয়েছে বলে মনে হয়?
লোপামুদ্রা: না! একেবারেই তা মনে হয় না। আমি ‘বেণীমাধব’ গেয়েছি,‘ধা ধি না না তি না’ গেয়েছি। রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছি, প্রেমের গান গেয়েছি। স্বাধীন ভাবে অনেক কাজ করেছি। জয় আমায় দিয়ে নানা রকম গান গাইয়েছে, আবার আমি সুমনদা’র গানও গেয়েছি। বিভিন্ন ধরনের গান গেয়েছি আমি, সে বিষয়ে কোনও আফসোস নেই। তবে সিনেমায় সে ভাবে আমায় ব্যবহার করা হয়নি বলতে পারেন। সেই ২০১২ সালে ‘তোর মতন কেউ নেই’-এর (ছবি: হেমলক সোসাইটি, পরিচালক: সৃজিত মুখোপাধ্যায়) পর আমায় আর কেউ কখনও ডাকল না। কে জানে আমার কণ্ঠের সঙ্গে হয়তো টালিগঞ্জের কোনও নায়িকার মুখ সে ভাবে যায় না।
প্রশ্ন: এতগুলো বছর পরও কিছু না-পাওয়া থেকে গেল কি?
লোপামুদ্রা: অনেক কিছু। এখনও অনেক গান গাওয়া বাকি। আমি মনে করি, গানের জন্য আমার আরও একটা জন্মের প্রয়োজন।