এক বছর ধরে পারিবারিক বিবাদের পর অবশেষে দক্ষিণ আফ্রিকায় জুলু রাজ্যের নতুন রাজার অভিষেক হয়েছে। ননগোমা প্রাসাদে এক ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রিন্স মিসুজুলু কা জুয়েলথিনিকে শনিবার জুলু রাজার মুকুট পরিয়ে দেয়া হয়।
এই রাজকীয় অনুষ্ঠানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য মিসুজুলু কা জুয়েলথিনি আগের দিন যে সিংহ শিকার করেছিলেন, তার চামড়া তিনি পরিধান করেন। ঐ সিংহ শিকারের মধ্য দিয়ে তাকে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে জুলু জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার প্রশ্নে তিনিই উপযুক্ত নেতা। উৎসবের প্রস্তুতি হিসেবে ১০টিরও বেশি গরু জবাই করা হয়।
সাবেক রাজার এই ছেলের বয়স ৪৮ বছর, কিন্তু জুলু রাজপরিবারের কিছু সদস্য যুক্তি দেখিয়েছেন যে তিনি সিংহাসনের সঠিক উত্তরাধিকারী নন, এবং প্রয়াত রাজার উইল জাল করা হয়েছে।
রাজ্যাভিষেকের সময় হাজার হাজার লোক উপস্থিত ছিলেন। দিনের শুরুতে নতুন রাজা গবাদিপশু রাখার পবিত্র খোঁয়াড়ে প্রবেশ করে তার পূর্ব পুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। আগামী মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার এক রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাকে বরণ করে নেবে। কিন্তু আধুনিক দক্ষিণ আফ্রিকায় জুলু রাজার কোন আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই।
দক্ষিণ আফ্রিকার মোট জনসংখ্যার মধ্যে জুলুরাই সবচেয়ে বড় জাতিগোষ্ঠী এবং এই রাজ্যকে সরকার প্রতিবছর ৪৯ লক্ষ ডলার বাজেট প্রদান করে। ফলে জুলু রাজতন্ত্র সে দেশে বেশ প্রভাবশালী।
জুলু রাজ্যের রয়েছে এক গর্বিত ইতিহাস। ১৮৭৯ সালে ইসান্ডলওয়ানার যুদ্ধে জুলুরা ব্রিটিশ সৈন্যদের পরাজিত করে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিল। তবে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে যেসব যুদ্ধ হয়েছিল তা সবসময় ছিল ভয়ঙ্কর, এবং কখনও কখনও রক্তক্ষয়ী।
কিংবদন্তীতুল্য জুলু রাজা শাকা কা সেনজাঙ্গাখোনা ১৮১৬ সালে সিংহাসন দখলের লক্ষ্যে নিজের ভাইকে খুন করেছিলেন। এর কয়েক বছর তিনি নিজেও তার ভাতিজার চক্রান্তে নিহত হন।
কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় আগে সর্বশেষ জুলু রাজা গুডউইল জুয়েলথিনি কা ভেকুজুলুর মৃত্যুর পর রাজপরিবারের সর্বসম্প্রতি ঘটনাগুলো জনসাধারণের সামনে এক বিব্রতকর নাটকে পরিণত হয়েছে।
জুলু রাজপরিবারের মধ্যে বিভিন্ন উপদল বিভিন্নভাবে মামলা দায়ের করেছে এবং তাদের পছন্দের প্রার্থীদের রাজা বানানোর চেষ্টা করেছে।
সাবেক রাজা জুয়েলথিনির ছিল ছয়টি স্ত্রী এবং অন্তত ২৮টি সন্তান। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে তিনি রাজত্ব করেছেন।এক বিতর্কিত উইলে, প্রয়াত রাজা তার তৃতীয় স্ত্রী রানী মান্টফোম্বি দলামিনি জুলুকে রাজমাতা হিসেবে মনোনীত করেন। লক্ষ্য ছিল নতুন রাজার অভিষেক পর্যন্ত তিনি রাজ্য পরিচালনা করে যাবেন।
রানী মন্টফোম্বি প্রয়াত রাজার স্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কারণ তিনি নিজে এসেছিলেন আরেকটি রাজকীয় পরিবার থেকে। তার পিতা ছিলেন প্রয়াত রাজা দ্বিতীয় সোভুজা এবং তার ভাই ছিলেন প্রতিবেশী রাজ্য এসওয়াটিনির রাজা কিং তৃতীয় মেসওয়াটি।
জুলু রাজার সাথে রানী মন্টফোম্বির বিয়ের শর্ত ছিল যে তার স্বামীর মৃত্যুর পর তাদের প্রথম পুত্রই হবে সিংহাসনের দাবিদার।তিন মাস রাজমাতার দায়িত্ব পালনের পর রানী মন্টফোম্বিও যখন মারা যান তখন স্বাভাবিকভাবেই মনে করা হচ্ছিল যে তাদের ছেলে মিসুজুলু কা জুয়েলথিনিই ক্ষমতা হাতে তুলে নেবেন। তার মায়ের উইলেও উত্তরসূরি হিসেবে তার নাম রাখা হয়েছিল।
কিন্তু গোল বাঁধলও যখন প্রয়াত রাজার আরও দুই ছেলে সিংহাসনে ওপর নিজেদের দাবি তুলে ধরলেন। রাজপরিবার তিনভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এবং প্রত্যেক উপদল তাদের পছন্দের রাজপুত্রকে রাজা বানাতে চাইলো – মিসুজুলু কা জুয়েলথিনি, সিমাকাদে কা জুয়েলথিনি এবং বুজাবাজি কা জুয়েলথিনি।
গত মার্চ মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিকভাবে মিসুজুলু কা জুলেথিনিকে নতুন জুলু রাজা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু মিসুজুলুর নিজের ভাই এমবোনিসি জুলু মামলা করে রাজ্যাভিষেক বন্ধ করতে আদালতের আবেদন জানান। তবে আদালত তার আবেদনটি খারিজ করে দেয় এবং অভিষেক অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়।
জুলু ঐতিহ্য অনুযায়ী মিসুজুলুর অভিষেকের ঠিক এক সপ্তাহ আগে, রাজপরিবারের কিছু সদস্য তার সৎ ভাই প্রিন্স সিমাকাদেকে নতুন রাজার পদে সমর্থন জানান। তাদের যুক্তি ছিল, প্রিন্স সিমাকাদে প্রয়াত রাজার প্রথম পুত্র সন্তান। কিন্তু জুলু রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মাঙ্গোসুথু বুথেলেজি একে “মূর্খতা-পূর্ণ প্ররোচনা” বলে তাকে নাকচ করে দেন।
ওদিকে গত বৃহস্পতিবার নতুন রাজা জুয়েলথিনির আপন তিন ভাই সংবাদ সম্মেলন ডেকে প্রিন্স বুজাবাজিকে তাদের পছন্দের রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। তাদের দাবি হচ্ছে, সব ছেলের মধ্যে প্রিন্স বুজাবাজির সাথেই রাজার সম্পর্ক ছিল সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। তবে অনেকেই বিশ্বাস করেন, এই গৃহবিবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে উপজাতীয় সংঘাত।
নতুন রাজা মিসুজুলুর মা এসেছেন এসওয়াটিনি রাজ্য থেকে, যার অর্থ তার পুত্র ১০০% জুলু হতে পারেন না। এবং সেই কারণেই রাজপরিবারের কোন কোন সদস্য রানী মান্টফোম্বি রাজার মূল স্ত্রী হিসাবে পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারেননি।