ব্রাজিলের মারাকানা রাজত্বের অবসান ঘটালো লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। একমাত্র গোলে তিতের অপরাজেয় যাত্রা অবসার ঘটিয়ে কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন হলো আর্জেন্টিনা।
অবশেষে চির প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে হারিয়েই অধরা শিরোপার স্বাদ পেল আর্জেন্টিনা। অধিনায়ক মেসি পেলেন ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা। মারাকানায় ব্রাজিল সবশেষ ম্যাচ হেরেছিল ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে। সেই ম্যাচটি এখনও মারাকানা ট্র্যাজেডি নামে পরিচিত।
সেই ঘটনার ৭১ বছর পর ব্রাজিলিয়ানদের আরেকটি বেদনার উপাখ্যান উপহার দিল আর্জেন্টিনা। সবমিলিয়ে ঘরের মাঠে ২০১৪ সালের পর প্রথম কোনো ম্যাচ হারল ব্রাজিল আর কোপা আমেরিকা নিজেদের মাঠে ১৯৭৫ সালের পর এটিই প্রথম পরাজয় সেলেসাওদের।
আর্জেন্টিনাকে দীর্ঘ ২৮ বছর পর চ্যাম্পিয়ন করার পথে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মেসি। পুরো আসরে ৪ গোল ও ৫ এসিস্ট করে দলকে পাইয়েছেন শিরোপা। ফাইনাল ম্যাচে গোল-এসিস্ট না পেলেও পুরো ম্যাচেই জয়ের জন্য মরিয়া ছিলেন মেসি।
মেসির উদ্ভাসিত টুর্নামেন্টের দুর্দান্ত ইতি টানলেন রদ্রিগো ডি পল ও অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। ম্যাচের ২২ মিনিটের মাথায় রদ্রিগো ডি পলের দুর্দান্ত থ্রু বলে ব্রাজিলের অফসাইড ফাঁদ ভেঙে ঢুকে পড়েন ডি মারিয়া। বুদ্ধিদীপ্ত চিপ শটে সামনে থাকা গোলরক্ষককে পরাস্ত করে দলকে এগিয়ে দেন এ তারকা ফরোয়ার্ড। এই গোলের নিশ্চিত হয় শিরোপা।
ঐতিহাসিক মারাকানায় ৭১ বছর ধরে অপরাজিত স্বাগতিক ব্রাজিল। তাই কোপা আমেরিকা ফাইনালে জিততে নতুন ইতিহাস লিখতে হবে আর্জেন্টিনাকে। সেই মিশনে প্রথমার্ধে নিজেদের কাজটা ভালোভাবেই সেরেছে আলবিসেলেস্তেরা। ফরোয়ার্ড অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার দুর্দান্ত গোলে লিড নিয়েই বিরতিতে যায় আর্জেন্টিনা।
প্রথমার্ধ শেষে স্কোরলাইন দাঁড়ায় আর্জেন্টিনা ১-০ ব্রাজিল। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে সাজানো প্রথমার্ধে বল দখলের লড়াইয়ে দুই দল ছিলো প্রায় সমানে সমান। প্রথম ৪৫ মিনিটে ৫৪ শতাংশ সময় বলের নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্রাজিলের পায়ে। গোলের উদ্দেশ্যে অন্তত ৬টি শটও করেছে তারা। কিন্তু লক্ষ্যে ছিল মাত্র ১টি। সেটিতেও মেলেনি গোল।
অন্যদিকে ম্যাচের ২২ মিনিটের মাথায় রদ্রিগো ডি পলের দুর্দান্ত থ্রু বলে ব্রাজিলের অফসাইড ফাঁদ ভেঙে ঢুকে পড়েন ডি মারিয়া। বুদ্ধিদীপ্ত চিপ শটে সামনে থাকা গোলরক্ষককে পরাস্ত করে দলকে এগিয়ে দেন এ তারকা ফরোয়ার্ড। আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে ডি মারিয়ার এটি ২১তম, কোপা আমেরিকায় চতুর্থ এবং ব্রাজিলের বিপক্ষে প্রথম গোল।
দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলের ফাইনাল ম্যাচের একদম শুরুতেই আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার গনজালো মন্টিয়েলকে ফাউল করে হলুদ কার্ড দেখেন ব্রাজিল মিডফিল্ডার ফ্রেড। প্রথমার্ধে এরপর আর একবার পকেট থেকে কার্ড বের করতে হয়ে ম্যাচের রেফারি এস্তেবান ওস্তোজিচকে। সেটি দেখেন আর্জেন্টিনার লেয়ান্দ্র পারেদেস।
ম্যাচের পঞ্চম মিনিটে প্রথমবারের মতো ব্রাজিল রক্ষণে বল পায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু সেটিতে কোনো জোরালো আক্রমণ করতে পারেনি তারা। শুরুর মিনিট দশেক মাঝমাঠের দখল নিতেই কাটিয়ে দেয় দুই দল। তাই সে অর্থে বলার মতো কোনো আক্রমণ হয়নি তখন।
তেরতম মিনিটে গিয়ে গোলের উদ্দেশ্যে প্রথম শট নেন নেইমার। রিচার্লিসনের ব্যাক পাসে পাওয়া বলে হাফ ভলিতে শট করেছিলেন নেইমার। তবে সেটি ব্লক করে দেন আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার নিকোলাস ওটামেন্ডি। পরের মিনিটে ক্যাসেমিরোর ফাউলে মাঝমাঠে প্রথম ফ্রি-কিক পায় আর্জেন্টিনা, কাজে লাগেনি সেটি।
২০ মিনিটের মাথায় নেইমারের পাস থেকে গোলের উদ্দেশ্যে শট নেন রিচার্লিসন। এবার ব্লক করেন এ ম্যাচ দিয়েই দলে ফেরা ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো। ফাইনালের জন্য আর্জেন্টিনা একাদশে আনা পাঁচ পরিবর্তনের অন্যতম ছিলেন রোমেরো। নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিতেও সময় নেননি তিনি।
এর দুই মিনিটের মধ্যে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। অফফর্মে থাকা ফরোয়ার্ড নিকোলাস গনজালেজকে বসিয়ে ফাইনালের শুরুর একাদশে ডি মারিয়াকে জায়গা দিয়েছেন আর্জেন্টিনা কোচ লিওনেল স্কালোনি। সেই ডি মারিয়াই দলকে এনে দিয়েছেন প্রথম সাফল্য।
গোল খেয়ে ম্যাচে ফিরতে মরিয়া হয়ে পড়ে ব্রাজিল, বাড়িয়ে দেয় আক্রমণের মাত্রা। বিশেষ করে শেষ বাঁশি বাজার ঠিক আগে কর্নার থেকে সুযোগ তৈরি করেছিলেন নেইমার। কিন্তু ডি-বক্সে সেটিতে যথাযথ হেড করতে পারেননি মার্কুইনহোস, থিয়াগো সিলভারা। ফলে পিছিয়ে থেকেই বিরতিতে যেতে হয়েছে স্বাগতিকদের।
আক্রমণের ধার বাড়ানোর লক্ষ্যে দ্বিতীয়ার্ধে মিডফিল্ডার ফ্রেডকে উঠিয়ে ফরোয়ার্ড রবার্তো ফিরমিনোকে নামান ব্রাজিল কোচ তিতে। এর সুফলও মেলে দ্রুতই। দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই আর্জেন্টিনার রক্ষণে চা প্রয়োগ করতে থাকে ব্রাজিল। আক্রমণ ঠেকাতে ফাউল করে হলুদ কার্ড দেখেন জিওভানি লো সেলসো।
ম্যাচের ৫২ মিনিটে সাজানো আক্রমণে ওঠে ব্রাজিল। প্রায় মাঝমাঠ থেকে থ্রু বল এগিয়ে দিয়েছিলেন লুকাস পাকুয়েতা। সেটি রিসিভ করার সময়েই অফসাইডে ছিলেন রিচার্লিসন। সেই বল ধরে ছয় গজের বক্সে ঢুকে বল জালেও জড়ান তিনি। কিন্তু অফসাইডের পতাকা তুলে উদযাপন থামিয়ে দেন রেফারি।
এই অফসাইডের পরপরই খেলোয়াড় পরিবর্তন করেন আর্জেন্টিনা কোচ লিওনেল স্কালোনি। প্রথম হলুদ কার্ড দেখা লেয়ান্দ্র পারেদেসকে তুলে নিয়ে গুইদো রদ্রিগেদজকে নামান তিনি। এর মিনিটখানেক বাদে খুব কাছ থেকে জোরালো শট নেন রিচার্লিসন। তবে সেটি ঠেকিয়ে দেন আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ।
এর এক মিনিট পর ডি-বক্সের মধ্যে পেনাল্টির আবেদন করেন নেইমার। তবে তাতে সাড়া দেননি রেফারি। ম্যাচের ৬৩ মিনিটে লো সেলসো জায়গায় নামানো হয় নিকোলাস তালিয়াফিকোকে। ব্রাজিল তুলে নেয় মাঠে নিষ্প্রভ থাকা এভারটনকে, নামায় ভিনিসিয়াস জুনিয়রকে।
ভিনিসিয়াস নামার পর গতি বাড়ে ব্রাজিলের আক্রমণে। তবে সেগুলো দক্ষতার সঙ্গেই ঠেকাতে থাকে আর্জেন্টিনা। আক্রমণ আরও বাড়াতে ৭৬ মিনিটে রেনাল লোদির জায়গায় এমারসন ও লুকাস পাকুয়েতার জায়গায় গ্যাবিগোলকে নামান ব্রাজিল কোচ তিতে।
মিনিট দুয়েক পর একসঙ্গে তিন পরিবর্তন করেন আর্জেন্টিনা কোচ লিওনেল স্কালোনি। ক্রিশ্চিয়ান রোমেরোর জায়গায় জার্মান পেজ্জেল্লা, লাউতারো মার্টিনেজের জায়গায় নিকোলাস গনজালেজ ও গোলস্কোরার ডি মারিয়ার জায়গায় এজেকুয়েল পালাসিওসকে নামানো হয়।
এতগুলো পরিবর্তনের লক্ষ্য ছিল নিজেদের রক্ষণভাগের শক্তি বাড়ানো। যা দারুণভাবেই কাজে লাগে ম্যাচের বাকি সময়ে। ম্যাচের ৮৭ মিনিটের সময় ডি-বক্সের ভেতরে বাম পাশ থেকে বুলেট গতির শট নেন গ্যাব্রিয়েল বারবোসা তথা গ্যাবিগোল। দুর্দান্ত ক্ষিপ্রতায় সেই শট ঠেকান এমিলিয়ানো মার্টিনেজ।
পরের মিনিটেই দ্রুতগতির আক্রমণে উঠে যান লিওনেল মেসি ও রদ্রিগো ডি পল। প্রথমে ডি পলকে বল এগিয়ে দিয়ে ডি-বক্সের মধ্যে ঢুকে পড়েন মেসি। পরে বুদ্ধিদীপ্ত পাসে ডি-বক্সের মধ্যে মেসিকে বল এগিয়ে দেন ডি পল। সেই বল ঠিকঠাক নিয়ন্ত্রণে নিতে না পারায় গোলের সহজ সুযোগ হাতছাড়া হয় মেসির।
এরপরও ম্যাচে ফেরার চেষ্টা চালিয়ে যায় ব্রাজিল। কিন্তু তাদের সব প্রচেষ্টাই ডি-বক্সের আশপাশ থেকে ফেরাতে থাকে আর্জেন্টিনা। নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষে যোগ করা হয় ইনজুরি টাইমের অতিরিক্ত ৫ মিনিট। সেই ৫ মিনিট শেষ হতেই বাঁশি বাজান রেফারি আর শিরোপার উল্লাসে ফেটে পড়ে পুরো আর্জেন্টিনা শিবির।