রেলপথের উদ্ভাবন যেমন মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা করেছিল, তেমনি চিরকালের জন্য পাল্টে দিয়েছিল সময়ের ধারণা। এক সময় মানুষ সূর্যের অবস্থান দেখে সময় নির্ধারণ করত। তাই প্রতিটি শহরে সময়ের নিজস্ব মানদণ্ড ছিল। এক শহরের সঙ্গে আরেক শহরের সময়ের কোনো সামঞ্জস্য থাকত না।
অবশ্য সে সময় দ্রুতগামী কোনো যানবাহন না থাকায় মানুষ কোনো সামরিক অভিযান ছাড়া বা বাণিজ্য ছাড়া বেশি দূর যেত না। ফলে সময়ের তারতম্য তেমন সমস্যাও সৃষ্টি করত না। কিন্তু রেল উদ্ভাবনের পর সময়ের ধারণা পুরোপুরি পাল্টে যায়।
১৮৮৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার রেলপথ কোম্পানিগুলো ‘টাইম জোন’-এর ধারণা চালু করে, যা মানুষের সময় নির্ধারণের পদ্ধতি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। টাইম জোন বা ‘সময় অঞ্চল’ হলো পৃথিবীকে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করার একটি পদ্ধতি, যেখানে প্রতিটি অঞ্চল নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে থাকে। এটি মূলত গ্রিনউইচ মান সময় তথা জিএমটি বা ইউনিভার্সাল টাইম তথা ইউটিসি থেকে হিসাব করা হয়।
বাল্টিমোরের বি অ্যান্ড ও রেলপথ জাদুঘরের প্রধান কিউরেটর জন গোল্ডম্যানের মতে, ১৮০০-এর মাঝামাঝি সময়ে যখন রেলপথ বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তখন একটি সমন্বিত সময়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
এটি শুধু দক্ষতার ব্যাপার ছিল না, বরং এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও জরুরি ছিল। এ সময় স্থানীয় সময় পরিমাপগুলো রেলপথের জন্য বড় সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতে, মানুষ ট্রেন মিস করতে পারে আর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে, একটিমাত্র ট্র্যাক ব্যবহার করার কারণে ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষের সম্ভাবনা বাড়ে।
প্রথম দিকে যুক্তরাজ্যেও একই ধরনের সমস্যা হয়েছিল। ভিন্ন ভিন্ন শহরের রেলস্টেশনগুলো স্থানীয় সময় অনুযায়ী ট্রেনের আগমণ ও ছেড়ে যাওয়ার সময় ঠিকমতো তালিকাভুক্ত করতে পারত না। ফলে ১৮৪৭ সালে ব্রিটিশ রেলওয়ে একটি একক ‘রেলওয়ে সময়’ গ্রহণ করেছিল। ১৮৮০ সালে এটি আনুষ্ঠানিক সময় হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং গ্রিনউইচ মান সময় তথা জিএমটি নাম দেওয়া হয়। যুক্তরাজ্য প্রথম দেশ হিসেবে এমনটি করে।
যুক্তরাজ্যের পর এই ধারণাটি উত্তর আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়ে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার জন্য দরকার ছিল পুরো মহাদেশে সময়ের মান নির্ধারণ করা। ১৮৭৯ সালে কানাডীয় প্রকৌশলী স্যার সানফোর্ড ফ্লেমিং সময়মতো ট্রেন ধরতে না পারার পর টাইম জোনের ধারণা প্রস্তাব করেন।
১৮৮৩ সালের ১৮ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার রেলওয়ে সংস্থা ফ্লেমিংয়ের ধারণা গ্রহণ করে পুরো উত্তর আমেরিকাকে পূর্ব, কেন্দ্রীয়, পাহাড়ি এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় নামে ৪টি প্রধান টাইম জোনে ভাগ করা হয়, যা আজও ব্যবহার হচ্ছে। নতুন একক টাইম জোন ব্যবস্থার ফলে রেলপথে দুর্ঘটনা অনেক কমে যায়।