আট বছর আগে রাজধানীর রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় ঢুকে কয়েক যুবক পরিবারের সদস্যদের জিম্মি করে বেসরকারি টেলিভিশনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক নুরুল ইসলাম ফারুকীকে হত্যা করেছিলেন। ওই ঘটনায় হওয়া মামলা পুলিশের তিনটি ইউনিট তদন্ত করে। ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তদন্তের সঙ্গে যুক্ত থানা-পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) কর্মকর্তারা বলে আসছিলেন, জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্যরা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে হত্যা করেছেন। দুর্ধর্ষ জঙ্গি হাদিসুর রহমান ওরফে সাগর ফারুকী হত্যায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে হত্যায় অংশ নেওয়া ৯ জঙ্গির নামও বলেছিলেন।
তবে আট বছরের মাথায় এসে এখন সিআইডি বলছে, ফারুকী হত্যায় মামলার কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে তারা। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, ফারুকীর মতাদর্শে ক্ষুব্ধ ছিল জেএমবির একটি গ্রুপ। ডাকাতিতে অভ্যস্ত জঙ্গিদের ফারুকীর বাসায় ডাকাতিতে প্রলুব্ধ করে জেএমবি এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এতে ছয় জঙ্গি অংশ নেয়। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলেছ। তবে ফারুকী খুনের ঘটনায় ২০২০ সাল পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা ১৬ জঙ্গির এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন: উখিয়ায় ট্রাকচাপায় ৪ জনের মৃত্যু
২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাতে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় ঢুকে কয়েক যুবক পরিবারের সদস্যদের জিম্মি করে নুরুল ইসলাম ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা করেন। এ ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন নিহত ফারুকীর ছেলে ফয়সাল ফারুকী। ফারুকী হাইকোর্ট মাজার জামে মসজিদের খতিব ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ইসলামি ফ্রন্টের (মতিন) সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আন্তর্জাতিক সম্পাদক ছিলেন।
সিআইডি সূত্র জানায়, ফারুকী হত্যা মামলাটি প্রথমে শেরেবাংলা নগর থানা-পুলিশ তদন্ত করলেও ওই বছরেই ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগে স্থানান্তর করা হয়। ২০১৫ সালে মামলার তদন্তভার সিআইডিকে দেওয়া হয়। সেখান থেকে মামলাটি আবার তদন্তের দায়িত্ব পায় ডিবি। ২০১৬ সালে মামলার তদন্তভার সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। কয়েক মাস পর মামলার তদন্তভার সেখান থেকে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমে দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে সেখান থেকে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডির ঢাকা মেট্রোর পশ্চিম বিভাগ। ২০২১ সালে সেখান থেকে মামলার তদন্তভার সিআইডির ঢাকা মেট্রোর দক্ষিণ বিভাগ পায়। এ নিয়ে আটবার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয় ফারুকী হত্যা মামলায়।
২০১৭ সালে মামলাটি সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ মামলার তদন্ত করে। ওই বিভাগের তৎকালীন বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম (বর্তমানে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার) সাংবাদিকদের বলেছিলেন, গুলশানে হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা মামলায় গ্রেপ্তার জঙ্গি হাদিসুর রহমান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। হাদিসুর রহমান জবানবন্দিতে বলেন, ফারুকী হত্যাকাণ্ডে জেএমবির নয়জন অংশ নিয়েছেন।
আরও পড়ুন: চবির ‘বি’ ইউনিট: পাস ১১৫৩৫, ফেল ১৫০৬৯
তখনকার সিআইডির কর্মকর্তারা বলেন, ফারুকী হত্যায় মূল কমান্ডার ছিলেন জেএমবির শীর্ষ নেতা আনোয়ার হোসেন ফারুক ওরফে জামাই ফারুক (ভারতে গ্রেপ্তার)। হাদিসুর রহমান আদালতকে বলেন, জেএমবি নেতা সাঈদুর রহমানের (কারাবন্দী) নেতৃত্বাধীন একটি, আবদুর রহমান ওরফে সারওয়ার জাহান মানিক ও চিকিৎসক নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে আরেকটি গ্রুপ হত্যায় অংশ নেন। ফারুকী হত্যাকাণ্ডের আগের দিন ২০১৪ সালের ২৬ আগস্ট সন্ধ্যায় আশুলিয়ায় একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের পাশে জঙ্গি মানিক, জামাই ফারুক, সাগর, আবদুল্লাহ আল তাসনীম ওরফে নাহিদ, আশফাকসহ অন্তত ৯ জন বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকে ফারুকীকে হত্যার ছক চূড়ান্ত করেন তাঁরা। পরদিন ফারুকীর রাজাবাজারের বাসায় চলে যেতে বলা হয় সবাইকে।
এর আগে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ছিলেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার সামসুন নাহার। তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ফারুকীর মতো একই কায়দায় খুন করা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খান ও আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় গ্রেপ্তার করা তিনজনকে ফারুকী হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ডিবির তৎকালীন যুগ্ম কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম (বর্তমান পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক) গোপীবাগের ছয় খুনে অংশ নেওয়া জেএমবি নেতা আলবানি ওরফে মাহফুজ ওরফে হোজ্জা গত বছরের ২৫ নভেম্বর গাবতলীর দীপনগরে ডিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আহত এবং পরে হাসপাতালে মারা যান। মাহফুজ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ডিবি কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, তিনি ভাড়ায় গোপীবাগে ছয় খুন ও টিভি চ্যানেলের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ফারুকীর হত্যায় অংশ নিয়েছিলেন। মাহফুজ মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, জেএমবির শীর্ষ নেতার পরিকল্পনায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটে।
ফারুকী হত্যায় এখন পর্যন্ত তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা শায়খ মোজাফফর বিন মুহসিনসহ নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের তিনজন, জেএমবির ছয়জন ও হুজিবির (হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের) তিন সদস্যসহ ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছিলেন। এর মধ্যে অধিকাংশ কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে গেছেন।
মামলার বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির ঢাকা মেট্রোর (দক্ষিণ) অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জিসানুল হক। গত বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, আগে গ্রেপ্তার ১৬ জঙ্গির ফারুকী হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। এখন তদন্তে বেরিয়ে এসেছে জেএমবির মধ্যম সারির কয়েক নেতা ফারুকীর মতাদর্শে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা নেন। ডাকাতি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে দীক্ষা পাওয়া ছয় জঙ্গি জামিনে বেরিয়ে এলে তাদের দিয়ে ফারুকীকে হত্যা করিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন জেএমবির নেতারা। আর জঙ্গি ডাকাতেরা ফারুকীকে হত্যা করে তাঁর বাসায় ডাকাতি করে নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার ও মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে যায়।
আরও পড়ুন: নজরুল: চির প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি
সিআইডির কর্মকর্তা জিসানুল হক বলেন, ফারুকীকে হত্যায় অংশ নেওয়া জঙ্গিরা গা ঢাকা দিয়েছে। তাঁদের মধ্যে দুজনের পূর্ণাঙ্গ নাম–ঠিকানা পাওয়া গেছে। এখন তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিয়ে শিগগিরই এ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
অবশ্য গত বছরে জিসানুল হক বলেছিলেন, কোনো গ্রুপ বা ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এক জঙ্গির দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিনির্ভর তদন্ত এগোচ্ছে না। বিষয়টি জঙ্গিদের কাজ, এখনো বলা যাবে না।
নুরুল ইসলাম ফারুকীর ছেলে আহমেদ রেজা ফারুকী মামলার তদন্ত নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এত দিন পরও মামলার এখনো তদন্ত চলছে। একের পর এক মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বদল হচ্ছে, আর প্রত্যেকের কাছেই আমাদের সেই পুরোনো কথা বলতে হয়। তাঁরা প্রভাবশালীর কালো ছায়া থেকে মামলার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন।